কাজলরেখা পর্ব-০৪।Kajalrekha part-04


💬হঠাৎ ছোট বাচ্চা মেয়ের মিষ্টি কন্ঠে ব্যবাচেকা খেয়ে উঠল ও।

এই জঙ্গলে বাচ্চা মেয়ে আসবে কোথা থেকে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল। কিন্তু কোথাও কোন বাচ্চা বা তার চিহ্নমাত্র নেই। তবে কি ও ভুল শুনেছে। নাকি অন্য কিছু।

ততক্ষণে বিকাল হয়ে গেছে। নদীতীরে মৃদু হাওয়া বইছে । চারদিকে শোন যাচ্ছে কিচিরমিচির শব্দ। 

" তুমি দেখতে খুব সুন্দর,নাম কি তোমার।এই জঙ্গলে একা একা কি করো। পথ হারিয়ে ফেলেছ নাকি" 

নরম মিষ্টি কন্ঠে কথাগুলো শুনছিল বিক্রম। কিন্তু কথাগুলো বলছে কে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। কিছুটা ভয়‌ও পেল। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বিক্রমকে। শরীরটা টলটল করছে। দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।

" কে তুমি, এভাবে আড়ালে লুকিয়ে কথা বলছো কেন।আর জঙ্গলে একা কি করছো,ভয় করেনা তোমার" 

খানিকটা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কথাগুলো বললো বিক্রম।

" নিজের সামনের গাছটির দিকে তাকাও তুমি"


সামনের গাছের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল বিক্রম। নানা রঙে রাঙানো একটা পাখি গাছের ডালে বসে আছে। ঠোঁট আর পা দুটো টকটকে লাল। গায়ে সবুজের ছড়াছড়ি। অনেকটা টিঁয়া পাখির 🐦 মতো দেখতে। আকারে বেশ বড়। পিঠের উপরের অংশ চিকচিক করছে। ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে এই পাখিটাই কথা বলছে ওর সাথে। পাখিটা দেখতে যতটা মিষ্টি তার থেকে ওর কন্ঠস্বর বেশি মিষ্টি।

 ছোট বাচ্চারা যেমন খিলখিল করে হাসে , তেমন করে হেসে পাখিটা আবার বলতে লাগল,,,

" আমার নাম হিরামন পাখি। আমি এই জঙ্গলেই থাকি। আমার সখির নাম রুপামন। আমাদের গুরুজি আমাদের এই নাম দিয়েছেন"


" গুরুজি খুব ভালো মানুষ। আমাদের খুব ভালোবাসেন"

মানুষের কথা শুনে অনেকটা দম ফিরে পেল বিক্রম। পাখিটির মিষ্টি কন্ঠে মন ভুলে গেল বিক্রমের।


" তোমার নামটা কিন্তু বললে না,, আমি এইপথ দিয়ে ই যাচ্ছিলাম। তোমাকে দেখে নিতে নেমে এলাম। গুরুজি আমার অপেক্ষায় আছেন"


বিক্রম এতক্ষণ মুর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল। জিবন্ত মুর্তিটা কথা বলতে শুরু করল।


" আমি বিক্রম, সুদূর পলাশপুর গ্রামে থেকে এসেছি....."


সবকিছু ই বললো হিরামনের কাছে বিক্রম। অনেক সময় পর বিক্রম কিছু টা হালকা হলো। কিন্তু পেটের খুদা খুব বেশি যন্ত্রনা দিতে লাগল।


 "তুমি ই তাহলে সুন্দরগড় রাজ্যের হবু রাজা মহারাজ বিক্রম সেন"


মিষ্টি কন্ঠে চিৎকার দিয়ে বলল পাখিটা। কিন্তু ওর কথার কোন মানেই বুঝে উঠতে পারল না বিক্রম।


"কি ভুলভাল বকছো,, কোথায় আমি আর কোথায় রাজ সিংহাসন আর কোথায় আমি"


হকচকিয়ে একদমে বলল বিক্রম।


"তুমি চলো আমার সাথে গুরুজির কাছে উনিই সব বলবেন"


"চলো...."


পাখিটা ওর সামনে সামনে উড়তে লাগলো।বিক্রম ওর দেখানো পথে চলতে লাগল। আসলেই এ জঙ্গলে মানুষের আনাগোনা একদম কম। লতাপাতায় জড়িয়ে আছে গাছগুলো। হিংস্র জানোয়ারের প্রাদুর্ভাব তেমন একটা নেই।তবে রাত হলেই শিয়ালের ডাক শোনা যায় সবসময়।


অনেক আগে এই জঙ্গলের সিমানা ঠিক এখানটায় ছিল না। এখানে ছিল বিশাল এক সম্রাজ্য। নাম ছিল হিমপুর রাজ্য। রাজা,রানি,মন্ত্রি,সভাসদ,গমগমে রাজদরবার সবকিছু ছিল এখানে। ছিল হাতিসালে হাতি 🐘 ঘোড়াসালে ঘোড়া 🏇,,,জশ জৌলুশ সবকিছু ছিল এখানে। হঠাৎ কোন এক মনিষির অভিশাপে এই লোকালয় এলাকা নাকি জঙ্গলে রুপান্তরিত হয়। অনেক কাহিনী আছে এই জঙ্গল নিয়ে। লোকমুখে শোনা যায় এখানে নাকি এখনো সেই মনিষিকে দেখা যায়।তার‌ই নামে এই জঙ্গলের নামকরণ করা হয় বরুনের জঙ্গল। কালোজাদু আর পিচাশি শক্তিতে বরুন বিখ্যাত।


এসব কথা বলতে বলতে ওরা চলে আছে ছোট একটা কুটিরের কাছে। জায়গাটা খুব সাজানো গোছানো। কুঠিরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক দেবদারু গাছ। গাছের নিচে বসে আছে একজন বৃদ্ধ লোক। লোকটার চুল দাড়ি অনেক বড় বড়। বয়সের ভারে চুলদাড়ি পেকে গেছে। কুঠিরের সামনে ছোট একটা উঠোন। উঠোনে নরম ঘাসে ভরা। উঠোনের চারদিক ফুল গাছ দিয়ে আটানো। প্রতিটি গাছেই কমবেশি ফুল আছে।তবে অনেকগুলো গাছ‌ই অপরিচিত। ফুলের ঘ্রাণে জায়টার সৌন্দর্য আরো যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে।


এতক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখছিল বিক্রম। শেষমেষ কিনা কোন এক মানুষের দেখা মিললো।


" কাকে নিয়ে এলি হিরামন"


প্রবিন কন্ঠে দু একটা কাশি দিয়ে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

" এটা তোমার বলা গল্পের সেই বিক্রম সেন। দূর দেশ থেকে এসেছে"


আদো আদো ভাষায় বলল হিরামন। এদিকে বিক্রমের খুদা পেটে জ্বালাতন করছিল। সে আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারছে না। লজ্জার মাথা খেয়ে বয়স্ক লোকটাকে জিঙ্গেস করলো ঘরে খাবার আছে কিনা। লোকটা বিক্রমের সাথে কোনরুপ কথা না বলে ঘর থেকে কিছু ফল আর শুকনো খাবার নিয়ে এল। 


" এগুলো খেয়ে নাও। আমার এক শিশ্য আছে। প্রায়ই আসে, আসার সময় শুকনো খাবার কিনে নিয়ে আসে"


খাবার দেখে হামলে পড়ল না বিক্রম। খুব স্বাভাবিক ভাবে খাবার টা খেয়ে নিল। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বয়স্ক লোকটা ওকে ঘুমিয়ে যেতে বললেন। কারন ওর উপরে অনেক ধকল গেছে।বিক্রম কোন কিছু না ভেবে তার ক্লান্ত শরীরটাকে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেল ছেলেটা। ঘুমন্ত বিক্রমকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল বৃদ্ধ লোকটা।বিক্রম নিজেও যানে না তার জন্য কি অপেক্ষা করছে। তবে কি সে আরো বড় কোন বিপদে পড়তে চলেছে। কে এই বৃদ্ধ লোক,,যে এত বয়স হ‌ওয়া সত্ত্বেও গহীন অরণ্যে থাকে।


সকালটা পাখির 🐦 কিচিরমিচির শব্দে নয় ছোট্ট একটা জগড়ায় ঘুম ভাঙল। শরীরটা বেশ ব্যথা করছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। বাইরে এসে দেখল বয়স্ক লোকটা গাছে পানি দিচ্ছে। এগিয়ে গেল ওনার কাছে।


" এখন তোমার শরীর কেমন। দুর্বলতা কেটেছে"


"হ্যাঁ, অনেক ভালো লাগছে,তবে আপনি এখানে,এই বয়সে ,একা কিভাবে থাকেন?"


" বাবা আমি পথ প্রদর্শক। তোমার মতো অনেক লোক এখানে পথ ভুলে আসে। তাদেরকে আমি পথ দেখিয়ে দেই।তবে বিক্রম, তুমি এই রাজ্যের রাজা হতে চলেছ এটা সত্য। কেননা তোমার অপেক্ষায় আমি এতদিন ধরে"


তোমাকে নিজের গ্রামের মানুষ অপমান করেছে, তারপর তুমি আত্মহত্যা করেছিলে, এখানকার মাঝি তোমাকে পেয়ে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এখানে আসতেই নৌদুর্ঘটনায় তোমার সাথি এদেশিয় মাঝি মারা গেছে। আমার কথা ঠিক আছে তো!!"


অবাক হয়ে শুনছিল বিক্রম। এটাও কি সম্ভব। একজন মানুষের চেহারা দেখে কি তার অতীত বলে দেয়া সম্ভব।এমন সময় এক জোড়া পাখি উড়ে এসে বসলো বিক্রম যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক সামনের গাছের ডালে।


"কি এবার বিশ্বাস হলো । আমার কথা তো বিশ্বাস করলে না"


" কিন্তু এসব উনি জানলেন কিভাবে হিরামন"


" এই গল্পটা প্রায়‌ই শুনি আমরা। তোমার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা অস্বাভাবিক।কারন তুমি রটাতে চলেছ বিশাল উপন্যাস।সব‌ই তোমার নিয়তি"


" তোমাকে এখানে দু চারদিন অপেক্ষা করতে হবে"

বললেন বয়স্ক লোকটা


"কার অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। কেন অপেক্ষা করবো" 


অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল বিক্রম।


" সময় সবকিছু বলে দিবে। তুমি কোন টেনশন করো না ‌। নিশ্চিন্তে এখানে চারটা দিন কাটিয়ে দাও"


বলেই কুটিরের ভিতরে চলে গেল বয়স্ক লোকটা। এদের কথাবার্তা কিছুই মিথায় ডুকছে না।মাথা চুলকাতে চুলকাতে হিরামনের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে,,, ঠিক তখনই হিরামন......