•  
     
    কাজলরেখা পর্ব । Kajalrekha part-03

     

    বিক্রম নিরুপায়,তাকে যে এই মাটি ছেড়ে একদম ইচ্ছে করছে না।ইচ্ছে করছে চিৎকার দিয়ে বলতে,, আমি নির্দোষ,, আমি নির্দোষ। কিন্তু কিছুই যে আর করার নেই।

    "বাকি জীবনটা না হয় ওখানে ই কাটিয়ে দিলে"
    বিক্রম এবার বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিল।যে গ্রামের হাওয়া বাতাস খেয়ে ও এত বড় হয়েছে।সেই গ্রাম ছেড়ে দূরে চলে যেতে হবে😭
    বিধাতা এ তোমার কেমন খেলা😭
    কিছুই বলল না বিক্রম। 
    " তুমি চাইলে আমরা এক্ষনি র‌ওনা দিতে পারি।এক্ষন বেশি বেলা হয়নি।মেতে আমাদের প্রায় দুদিন লাগবে। আমি বাজার থেকে দুদিনের খাবার নিয়ে এসেছি। যাবে কিনা বলো"
    বিক্রম গ্রামের দিকে মায়ার নজরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল" চলে যাচ্ছি রে..আর কখনো ফিরব না 😭"
    মাঝি আর দেরি করল না। তার স্বদেশি অনেকে আছে এখানে। সবসময় একসাথে যায় সবাই দেশে। কিন্তু আজ পরান মাঝি কাউকেই কিছু বললো না।এই সময়টায় সবাই বাজার থেকে ফিরে সকালের খাবার খায়।তাই কেউ দেখল না পরান শাহ্ কোথায় যাচ্ছে।
    বিক্রম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পলাশপুর গ্রামের দিকে। মনে পড়ছে হাজার স্মৃতি।ঝরে পড়ছে ওর চোখ বেয়ে অশ্রু। চেনা জায়গাগুলো চোখের আড়াল হতে লাগল। নদীর পাড় ঘেসেই এগুচ্ছে ওদের ডিঙ্গি নৌকা ⛵।দেখতে দেখতে অনেক দূর চলে এল ওরা। গ্রাম আর দেখা যাচ্ছে না।
    একদিকে অথৈই পানি,অন্যদিকে গভীর জঙ্গল।নিরবতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট তরি। ওদিকে পরান মাঝির মনে প্রিয়জনের দেখার আগ্রহ বেশি মেতে লাগল।বৌ ছেলেমেয়ের কথা বেশি বেশি মনে পড়তে লাগল।
    দুপুর বেলা নৌকা আরো কিছুটা তীরে ভিড়িয়ে দূ্জনে খেয়ে নিল।রাত পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। তারপর সকালে আবার র‌ওয়া দিবে ওরা
    পরান মাঝির চেনা পথ তাই পথে তেমন বিপদ হয়নি। প্রায় দুই দিন পর ওরা প্রায় চলে এল সুন্দরগড় রাজ্যের কাছাকাছি।

    তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে পথ আর কিছুটা বাকি। সুন্দরগড়ের ছোট নদীর মুখে আসতেই অন্ধকার নেমে এল। অনেক গল্প শুনেছে এই সুন্দরগড়ের বিক্রম। ছোট নদীর দুই পাশেই গহীন বন। বনের জীবজন্তুর হাক-ডাক শোন যাচ্ছে নদী থেকেই। বিক্রম পরান মাঝিকে জিজ্ঞেস করল এখানে রাতটা থাকবে কিনা। কেননা এইসব ছোট নদীর মুখে অনেক ঘুর্নিস্রোত থাকে। কিন্তু মাঝি বললো," সমস্যা নাই।এটা আমাদের নদী। ছোটবেলা থেকেই এই নদীর পানিতেই হেসেখেলে বড় হয়েছি আমি। কোন ভয় নেই।"
    প্রিয়জনের প্রতি টান এবং বুকে অধিক সাহস নিয়ে নদীর মুখে দিয়ে প্রবেশ করতে লাগল।
    কোন ধরনের বিপদ ছাড়াই ছোটনদীর মধ্যে প্রবেশ করল ওরা। কিন্তু কে যানে কার নিয়তি কোথায় লেখা আছে। 
    ধীরে ধীরেই এগুচ্ছিল ওরা,কিন্তু তখন‌ই একটা মর্মাহত ঘটনা ঘটে গেল।একটা মালবাহি ট্রলার ভীষণ জোরে চালিয়ে আসছিল। চারদিকে বিদঘুটে অন্ধকার।কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সজোরে ধাক্কা লাগল ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায়। উল্টে গেল নৌকাটা‌।
    বিপদ বারবার যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে বাক্রমকে। এখানেও ঘুর্নিস্রোত কম না।আর ঘুর্নিস্রোতে তো মানুষ একদম সাঁতার কাটতে পারে না।
    কিন্তু ভাগ্যদেবতা যেন এবার মুখ তুলে তাকালেন বিক্রমের দিকে। পানির ঘোলা ওকে একদম তীরের কাছাকাছি নিয়ে এল। এখান থেকে সহজেই তীরে পৌঁছে গেল বিক্রম।
    মাঝি কিংবা নৌকা ⛵। কোনকিছুর‌ই কোন হদিস পেল না ও। অন্ধকারে নিজের গায়ের পশম‌ও দেখা যাচ্ছিল না। গলা ছেড়ে চিৎকার করে ডাক দিল বিক্রম।
    "পরান মাঝি" "পরান মাঝি"
    নিজের ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল।
    ও এখন কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
    হঠাৎ চিৎকার দিয়ে কান্না করতে লাগলো। কিন্তু কি হবে কেঁদে। চারদিক থেকে মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক শোনা যায়। দু একটা গাছ হঠাৎ হঠাৎ নড়ে উড়ছে। চারদিকে একটি থমথমে পরিবেশ।
    বিক্রম পাগলের মতো হয়ে গেল।কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।ওর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। এদিকে চারদিকে কোন জনমানুষের সাড়া নেই। শিয়ালের ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ও ভালো করে বুঝতে পারল এটাও জঙ্গলের ই অংশ। বিক্রম সাত পাঁচ না ভেবে একটা গাছে উঠে গেল। রাতটা অন্তত গাছে কাটাতে হবে। 

    রাতটা ভয়ে ভয়েই কেটে গেল।সারা রাতে ওর একফোঁটাও ঘুম এলো না।মনে পড়তে লাগল নিজের গ্রামের কথা, গ্রামের মানুষের কথা,পরান মাঝির কথা ,যে কিনা ওর জন্য কত কিছুই না করলো,,, হঠাৎ করে জীবনটা কি হয়ে গেল।এসব ভাবতে ভাবতে ওর সারা রাত কেটে গেল।
    পরান মাঝির কথা ও ভেবেছিল হয়তো বেঁচে আছে, কারন মাঝি মানুষ কম বেশি সাঁতার তো অবশ্যই জানে। তার উপরে নিজের দেশের নদী। কিন্তু কি হয়েছিল রাতে তা ঠিকমতো মালুম করতে পারল না বিক্রম।

     সকাল হতেই গাছ থেকে নেমে পড়ল বিক্রম। গাছ থেকে নেমেই মাঝির খোঁজ করতে লাগলো। 
    এই ছোট্ট নদীটার এপার থেকে ওপার স্পষ্ট দেখা যায়। উপারে ও এপারের মত ঘন জঙ্গল। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক ঐ পাশের তীরে নেমে এসেছে একটি ছোট খাল। জঙ্গলি খাল তাই স্রোত অনেক বেশি। কাল থেকে স্রোত নদীতে মেশার ফলে নদীর এই জায়গাটায় পানিতে ঘু্র্ণয়ন বেশি হয়। 
    চারপাশটায় এবার চোখ বুলিয়ে নিল বিক্রম,, চিকচিক করছে সাদা বালু সারা তীর জুড়ে। নদীর পাশেই ঘন জঙ্গল। দেখে বুঝা যায় এ জঙ্গলে মানুষের আনাগোনা খুব কম। এখান থেকে জনবসতি কত দূর তা ঠিক আন্দাজ করা যাচ্ছে না। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিক্রম। 
    নদীর পানিতে মুখ ধুয়ে নিল ও। এবার পরান মাঝিকে খুব জোরে সোরে ডাক দিল বিক্রম। অনেকটি ডাক দেয়ার পর ও কোন উত্তর এল না। তাহলে কি পরান মাঝি ওকে একা ছেড়ে চলে গেছে 😭 বিভিন্ন ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
    "এ কেমন বিপদে ফেঁসে গেলাম আমি,এর থেকে তো জলে ডুবে মরে যাওয়া ভালো ছিল। অনেক ডাকাডাকি করেও মাঝি কিংবা নৌকার কোন হদিস মিললো না 😭

    সুর্য প্রায় মাথার উপর উঠে গেছে। বিক্রমের পেটে খুব খুদা লেগেছে,,,গতরাতে কিছুই খায়নি।খেয়েছিল গতকাল দুপুরে। 
    কি করবে কোথায় যাবে এসব ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে পা বাড়াল বিক্রম। নদীর তীরে বেয়ে চলতে লাগল সামনের দিকে। তার গন্তব্য কোথায় সে নিজেও জানে না। জঙ্গল থেকে পাখির 🐦 মিষ্টি ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একটা কাঠবিড়ালী দেখা যাচ্ছে দৌড়ে পালাতে। গাছের ছায়া দিয়ে হাঁটতে লাগলো ছেলেটা। মনে হচ্ছিল যেন কোন রাজপুত্র পথ হারিয়ে মেঠোপথে চলছে। দুপুর গড়িয়ে সুর্যটা কিছুটা হেলিয়ে পড়েছে।সুর্যের তেজ কমেছে অনেক। কিন্তু বিক্রম একেবারে নিষ্তেজ হয়ে পড়ছে। অনেক দূর হেঁটেছে তার উপরে না খাওয়া। সবমিলিয়ে তার শরীর যে আর চলছে না। মন চায় এই বালুর উপরেই শুয়ে পড়তে।
     আর কিছুদূর যেতেই সামনে পড়ল জঙ্গল খরস্রোতা খাল।

    এবার কি করবে। এই শরীর নিয়ে এই খাল পার হ‌ওয়া মুশকিল। তারপর অচেনা এই জায়গা, সে জানেই না খাল পেরিয়ে সামনে গেলে লোকালয় পাবে কিনা। ক্লান্ত শরীর,মাথাভর্তি টেনশন নিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো পড়ল বিক্রম। একটা গাছের সাথে শরীরটা হেলিয়ে দিল।

    ভাবতে লাগলো তার সাথে হওয়া সমস্ত ঘটনা। সে এটাও জানে না জঙ্গলে কেমন প্রানি বসবাস করে। কতটা হিংস্র এ প্রানিরা তাও জানে না। এই মুহূর্তে কোন নৌকাও চোখে পড়ছে না। নিজেকে খুব‌ই অসহায় লাগছে বিক্রমের।
    এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ও ঘুমিয়ে পড়ল ও ঠিক মালুম করতে পারছে না। 
    হঠাৎ.......