কাজলরেখা পর্ব-০২।Kajalrekha part-02


জাহিদের বৌ: আরে ওকে জুতার মালা পড়ালেও মনে হয় লজ্জা হবে না,ওরে মাথা নাইরা ক‌ইরা আলকাতরা মাইখা দেওয়া উচিত।


জাহিদ: বাদ দাও,ওর জন্মের যে ঠিক আছে, তার কোন গ্যারান্টি আছে?? নাই!!


এইসব কথাবার্তা শুনে ওর নিজের প্রতি ঘৃণা হলো।যে গ্রামের লোকেদের ও এত  ভালোবাসতো তারাই ওর নিন্দা করছে😭😭 বিক্রম অনেক কষ্ট পেল । নিজেকে সামলাতে পারলো না ও। হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে চলে এল, নদীর পাড়েই বড় বড় দুটো আম গাছ,,, ছোট বেলায় এই আম গাছে উঠে কত‌ইনা লাফ দিয়েছে ও‌। অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে ওর ‌।

অতিরিক্তক্ত ভালোবাসা যখন ধোঁকা খায় তখন নিজের প্রতি মানুষের ঘৃনা জন্মায়। বিক্রম নিজের প্রতি হ‌ওয়া আকষ্মিক খারাপ ঘটনা মেনে নিতে পারেনি।তাই নিজের উপর ক্ষোভ জন্মে গেল খুব। মাথা ঠিক রাখতে পারলো না।তাই ও একটা পাগলামী করে বসলো।বিক্রম আম গাছে উঠে এক লাফ দিল। শেষ রাতের জোয়ারে নদীর পানি বেড়ে গেছে অনেক।আর তাছাড়া নদী কিছুটা গভীর এই জায়গাটায়।

এখানখান থেকে কিছুটা সামনেই ভীনদেশি জেলেরা মাছ ধরছে। 


দু চার মিনিট পর বিক্রমের শাঁস ফুরিয়ে এল। ও বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ওর সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। তখন শেষ রাত জেলেরা নদীর এদিকটায় জাল ফেলে রাখে শেষ রাতে । কিছুটা হলেও দেরি করে জাল তোলে ওরা। মিনিট পাঁচেক পর বিক্রম পানি খেতে লাগল। তার শক্তিশালী দেহটা নিশ্তেজ হতে লাগল। এক পর্যায়ে ও ঙ্গান হারাল।

 

ভিনদেশী মাঝি পরান শাহ্। তার নিবাস সুদূর সুন্দরগড় রাজ্য। এই এলাকায় বছরে বেশ কয়েকবার আসে। কিছু টাকা উপার্জন করে আবার চলে যায় নিজ দেশে। গতকাল থেকে পরান মাঝির শরিরটা একটু খারাপ। অনেক বৃষ্টিতে ভিজেছে গত পরশু দিন। এই দিকে বাড়ির কথাও খুব মনে পড়ছে তার। বাড়িতে ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ে আছে। একে শরীর খারাপ তার উপরে বাড়ির চিন্তা । তাই সারারাত জেগেই কাটিয়ে দিয়েছে আজ মাঝি। 


রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে। মাঝি শেষ বারের মত জাল ফেলেছে ।

 

একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে পরান। হঠাৎ ঝুপ করে পানিতে কি একটা পড়লো। মাঝি স্পষ্ট শব্দটা শুনতে পেয়েছে। ছ‌ইয়ের ভিতর দিয়ে নৌকার অন্য প্রান্তে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছ‌ই দেখতে পেলনা পরান শাহ্। আর কিছু না ভেবে চলে এল জাল তুলতে। এটাই শেষ বার। এরপর একটু ঘুরিয়ে নেবে ও। তারপর রাতের ধরা মাছ নিয়ে যাবে পলাশপুরের বাজারে। 


মাঝি জাল তুলতে গিয়ে অনেকটা অবাক হলো।কিছু একটা ভারি জিনিস বেঁধে আছে জালে। টানতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর।  কি বাঁধলো সেটা জানার আগ্রহ ও হলো ওর। তাই যথেষ্ট ধৈর্য নিয়ে টেনে তুললো জাল। কিন্তু ও যেটা দেখলো সেটা ভাবতে পারেনি । ভেবেছিল হয়তো কোন ভারি গাছের গুঁড়ি হবে। না হয়তো মরা কোন জানোয়ার হবে।


কিন্তু না এটা কোন মরা জানোয়ার, না এটা গাছের গুঁড়ি। এটা যে একটা মানুষ। মাঝি কিছুক্ষণ আগে শোনা শব্দের কারন এবার বুঝতে পারলো। তাই তাড়াহুড়ো করে জাল ছাড়াতে লাগলো। মাঝির বিশ্বাস ওকে বাঁচানো যাবে।

মাঝি তড়িগড়ি করে জাল ছাড়িয়ে নিলো ওর শরীর থেকে। একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে ছেলেটার পুরো শরীর। সুঠাম দেহ নিষ্তেজ হয়ে পড়ে আছে।চিনতে বাকি র‌ইল না মাঝির।বেশ কয়েকবার মাঝির সাথে কথা হয়েছে এই ছেলেটার।আর এটাও জানে যে এই ছেলেটা একদম একা।কেউ নেই ওর।


 বিক্রম দেখতে অনেক সুন্দর ছিল। মনে হচ্ছিল বেহেশতের কোন গেলমান মাঝির জালে উঠে্ে এসেছে  । চোখ দুটোর দিকে তাকালে মনে হবে পুরো পৃথিবীর মায়া ভরে আছে ওর চোখে।


 পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা বিক্রমকে তুলতে মাঝি অনেকটা হাঁফিয়ে উঠলো। কিন্তু তবুও উনি তাড়াতাড়ি করতে লাগলেন। প্রথমত বিক্রমকে মাঝি ছ‌ইয়ের মধ্যে নিয়ে এলেন। খুলে দিলেন শরীরের ভিজা কাপড়। মোটা কাঁথা জড়িয়ে দিলেন গায়ে। পরান মাঝি মানুষ টা খুব‌ই ভালো । বিক্রমের প্রতি সে এত যত্ন নিচ্ছিল যা একমাত্র কারো আপনজন‌ই করতে পারে।


মাঝি খেয়াল করলো বিক্রম অনেক পানি খেয়ে ফেলেছে। 


মাঝি বিক্রমকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে পেটে চাপ দিতে লাগল ‌। দু একবার চাপ দিতেই গলগল করে বেরিয়ে এল পানি বিক্রমের পেট থেকে। নষ্ট হয়ে গেল মাঝির ছোট্ট বিছানা। কিন্তু তাতে কি! বাঁচাতে হবে ওকে। যখন পানি বের হ‌ওয়া বন্ধ হলো বিক্রমকে আবার ঠিক করে শুইয়ে দিল মাঝি। এতবড় একটা শরীরটাকে নাড়াচাড়া করতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল পরান মাঝির। তার থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছিল তার মনে😭 যেন ছেলেটা বেঁচে যায় এই দোয়াই করছিল মনে মনে।সময় অনেক পেরিয়ে গেল কিন্তু বিক্রমের হুস এল না।

 

কিছু সময় অপেক্ষা করলো,,, তবুও ঙ্গান ফিরল না 😭 তবে ভারি কাঁথা গায়ে দেয়াতে শরীর গরম হয়ে উঠলো। মাঝির দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ঙ্গান ফিরছে না কেন।  এদিকে ভোর হয়ে গেছে। সুর্যটা উঁকি দিচ্ছে পুব আকাশে। অন্য মাঝিরা মাছ নিয়ে বাজারে যাচ্ছে। সকালের মৃদু হাওয়ায় মন ভোলানো সুখ পাওয়া যায়। মাঝি মনমরা হয়ে বসে আছে। এসব ভাবতেই তার মনে পড়ে গেল শান্তিগড়ের এক বৈদের কথা। কিভাবে পানিতে ডুবে যাওয়া মানুষের শাঁস প্রচালনা করতে হয়। 


পরান মাঝি আর দেরি করলো না। বৈদের শিখিয়ে দেয়া টেকনিক বিক্রমের উপর ট্রাই করতে লাগলো মাঝি। ওর মুখের সাথে মুখ মিলিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে লাগল মাঝি।


 কিছুক্ষণ করার পর একটা গোঙানির মত আওয়াজ করলো বিক্রম।


মাঝি যেন যুদ্ধজয় করে ফিরলেন। ঐ মুহুর্তে তার চোখে পানি চলে এল। 😭


মাঝি সরিষার তেল নিয়ে বিক্রমের বুকে, হাত-পায়ের তলায় মালিশ করতে লাগল। বেশিক্ষন দেরি করতে হলো না।


মাঝি যেন সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। মাঝির মুখের কোনে ছোট একটা হাসি ফুটিয়ে চোখ খুললো বিক্রম।


একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাঝি ওর দিকে। বিধাতার কি নিখুঁত সৃষ্টি।


চোখ মেলে তাকিয়ে বিক্রম নিজেকে ছোট্ট একটা ঘরে আবিষ্কার করল।ও তখন‌ও বুঝতে পারলো না আসলে ও এখন নৌকায়। 


মাঝি কিছুই বলছে না। তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছে দুটো স্টাচু একে অপরকে গভীরভাবে দেখছে।


নিরবতা ভাঙল বিক্রম:


" আমি কোথায়"


মাঝি নড়েচড়ে বসল।কিছুটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল‌,


 " বাবা তুমি নদীতে ঝাঁপ কেন দিয়েছিলে" ধীরে ধীরে মনে পড়লো বিক্রমের সবকিছু।হুঁ হুঁ করে কেঁদে দিল বিক্রম😭 সবকিছু খুলে বলল মাঝিকে। মাঝিকে বলতে গিয়ে বেশকিছুক্ষন কাঁদল বিক্রম।


মাঝি সব শুনে বিক্রমকে সান্ত্বনা দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলল। মাঝি বিক্রমকে বিশ্রাম নিতে বলে বাজারে চলে গেল মাছ নিয়ে,আর যাওয়ার সময় বলে গেল যেন বাইরে না যায়।


বাজারে গিয়ে অনেকের কাছে অনেক কথা শুনল পরান মাঝি। রোজিনা রাতেই গলায় দড়ি দিয়েছে।সে বিক্রমের থেকে গিয়ে আর ঘরে ফেরেনি। গ্রামের প্রতিটি মানুষের ক্ষোভ বিক্রমের উপর।তারা সবাই মনে করে  রোজিনার মৃত্যুর জন্য বিক্রম‌ই দায়ি।


মাঝি বাজারে বেশি দেরি করল না। তাড়াতাড়ি ফিরে এল ⛵ নৌকায়।


হালকা খাবার খেয়ে নিল দু'জন। বাজারে শোনা সবকথা বিক্রমকে বললো মাঝি।


বিক্রম এবার আরো ঘাবড়ে গেল।


"এখন কি করা উচিত মাঝি"


বলতে গিয়ে গলাটা ধরে আসছিল বিক্রমের।


"তুমি একটা কাজ করবে পারো। আমার সাথে আমার দেশে চলো। ওখানে আমি কোন একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেব"


বিক্রম নিরুপায়,তাকে যে এই মাটি ছেড়ে একদম ইচ্ছে করছে না।ইচ্ছে করছে চিৎকার দিয়ে বলতে,, আমি নির্দোষ,, আমি নির্দোষ😭