বরফ রানি পর্ব:০৩। Baraf Rani :part 03
 
না না, কালই বলা চলে। তবে এসবের কিছুই ও টের পাচ্ছে না। আপন মনে বরফের টুকরো কুড়িয়ে বেড়ায়। সেগুলোকে মেলানোর খেলা খেলে। নাম দিয়েছে এ খেলার। চীনা ধাঁধা নাকি এ।

কেই-এর বরফ টুকরোর নকশা দেখে কেই নিজেই মুগ্ধ হয়। ওর চোখে সেসব অসাধারণ ঠেকে। কেননা, ওর চোখে বিঁধে আছে যে কাঁচের টুকরো। আর তাই বরফের টুকরো সাজিয়ে কী যেন কী শব্দ বানাতে চায়, পারে না। তাতে কোন দুঃখও নেই তার। আসলে যে শব্দ ও বানাতে চাইছে, তা হচ্ছে ‘চিরকাল’। পারছে না। বরফ রানী বলেছে, নিজের শব্দটা যদি ও বানাতে পারে, তবে নাকি ও ওর নিজের মালিক বনে যাবে। বরফ রানী ওকে নাকি দিয়ে দেবে গোটা দুনিয়া আর এক নতুন জোড়া স্কেট। ও তো পারছে না।

বরফ রানী গরমের দেশে উড়ে যায়। ইটনা আর ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরিতে ফুঁ দেবে নাকি।

ফাঁকা খা খা বরফ ঘরে একলা একা বসে থাকে কেই। ভাবে আর ভাবে। কি যেন মনে পড়ে না ওর। কেইকে দেখে মনে হয়, এক টুকরো বরফের মূর্তি বুঝি ও। এভাবে বসে থাকলে হয়তো বা বরফের মূর্তিই হয়ে যাবে বেচারা। আর ঠিক তখন খুদে গেরডা প্রাসাদের ভেতর ঢোকে। আর ঠিক তখনি বরুফে বাতাস থেমে যায়, যেন ঘুমিয়ে পড়ে সব। গেরডা কেই-কে দেখে। ছুটে এসে বলে, ‘কেই! খুদে কেই! তোমাকে শেষমেশ খুঁজে পেলাম তবে!’

কেই মোটেও নড়ে না। শক্ত বরফ যেন ও।

তখন গেরডা দুঃখে কাঁদে। ওর চোখের গরম পানি পড়ে কেই-এর শরীরে। কেই-এর হৃদয়ে যায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে। আর ঠিক তখন কেই-এর হৃদয়ের বরফ টুকরো গলে যায়। গলে যায় সেই কাঁচের টুকরো। আর ঠিক তখন কেই তাকায় গেরডার দিকে। গেরডা গাইছিল গোলাপ ফুলের গান। যে গান কেই শুনেছিল ওদের সেই গোলাপের বাগানে। ওর মনে পড়ে যায় সব কথা। গেরডার কথা। দাদীমার কথা। বাগানের গোলাপগুলোর কথা। আনন্দে ডগমগ করে বলে, ‘গেরডা! খুদে গেরডা! কোথায় ছিলে তুমি এত দিন?’

কেই আর গেরডা হেসে ওঠে এক সাথে। আর সাথে সাথে চারপাশে বরফের টুকরোগুলো ওদেরকে ঘিরে নেচে ওঠে। হাসি শেষ হয়। বরফের টুকরোরাও থামে। শুয়ে পড়ে হ্রদের উপরে। আর তখন টুকরোগুলো যেন ঠিক ঠিক জায়গায় বসে যায়, হয়ে যায় সেই শব্দ যা কেই চাইছিল। হয়ে যায় নিখুঁত এক শিল্প। বরফ রানী যেমন বলেছিল, নিজের শব্দটা বানাতে পারলে কেই তার নিজের মালিক বনে যাবে। ঠিক তাই। কেই মুক্ত হয়ে গেল। পেয়ে গেল গোটা দুনিয়া। আর ওর পায়ে বসে গেল নতুন এক জোড়া স্কেট জুতা।

বলগা হরিণ ঠিকই অপেক্ষা ছিল ওদের। কেই আর গেরডাকে পিঠে নিয়ে হরিণ চলে এলো ফিন নারীর কাছে। চিমনি বাড়ির গরমে তাজা হ’ল বেশ। এরপর এলো ল্যাপ নারীর কাছে। তার বানানো নতুন জামা পরে নিল। ল্যাপ নারী স্লেজ গাড়িও ঠিক করে দিল। সেই গাড়িতে করে ওরা চলে এলো বরফ দেশের শেষ সীমানায়, যেখানে সবুজ পাতার কুঁড়ি চোখে পড়ল প্রথম। বলগা হরিণ আর ল্যাপ নারীকে বিদায় জানাতে হ’ল এখানে। তারপর ছুটল আবার।

আবার কানে এলো পাখির ডাক, কত দিন পরে! আবার কানে এলো ঘোড়ার পায়ের ধ্বণি। ঘোড়ার পিঠে বসা ছিল সোনালি জামা পরা সেই খুদে ডাকাত মেয়েটা।

গেরডা রাজপুত্র আর রাজকন্যারও খোঁজ করেছিল। পাওয়া গেল না তাদের। ভিনদেশে বেড়াতে গেছে নাকি।

আর সেই কাক বন্ধুটা?

বেচারার বয়স হয়েছিল। বেঁচে নেই আর।

দাদীমারও তো বয়েস হয়েছে অনেক। দাদীমা কেমন আছে? দাদীমাকে দেখবে বলে কেই আর গেরডা খুব জোরে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে চলে আসে নিজেদের বাড়িতে। ঘরে ঢুকে দেখে ওরেদ খুদে চেয়ারগুলো একই ভাবে রাখা। এর সামনে বসে আছেন দাদীমা। ওদের প্রিয় দাদীমা।

ওরা তখন কী করল?

এই কয় দিনে ওরা কিন্তু বেশ বড় হয়ে গেছে। আগের মতো অতটা খুদে শিশু নেই। কিন্তু দাদীমার কোলের কাছে ওরা আবার খুদে শিশু হয়ে এলো। ওদের হৃদয় আগের সেই খুদে শিশুর হৃদয়ই রয়ে গেল।

দাদীমা বলতেন, এখনো বলছেন, যে হৃদয় শিশুর নয়, সে হৃদয় স্বর্গে যাবে না।

কেই আর গেরডা খুদে কেই আর খুদে গেরডা হয়ে তাকায় দাদীমার দিকে। দাদীমার শরীরে খেলা করছে উজ্জ্বল সূর্যের আলো। যেখানে কোন কনকনে শীত নেই। কেবলই ঝকঝকে গ্রীষ্মকাল।

কেই আর গেরডাও অনুভব করে হৃদয়ের উষ্ণতা। ভালবাসে সুন্দর গ্রীষ্মকে। ভালবাসতেই থাকে